আশুলিয়ায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি দমাতে দমন-পীড়ন পথে গেছে মালিকরা: মোশরেফা মিশু
কোন প্রেক্ষিতে আমরা এ সমাবেশ করছি আপনারা জানেন। কি অপরাধ করেছিল আশুলিয়ার গার্মেন্ট শ্রমিকরা। শ্রমিকদের পেটে ভাত নেই, পরণে কাপড় নেই। সারা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশের এই গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি সব চেয়ে কম। বৈদেশিক মূদ্রার ৮২ ভাগ অর্জন করে এই শ্রমিকরা। শ্রমিকদের তৈরি পোশাক রফতানি করে সারা পৃথিবীতে দুই নম্বর দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। এই শ্রমিকরা, এখানে যারা কাজ করে এই শ্রমিকদের রক্তঘামে তৈরি হয় এই গার্মেন্টস। আপনারার জানেন সরকারি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন বেড়েছে। এর প্রভাবে বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, বাড়িভাড়া বেড়েছে। শিল্প এলাকাগুলোতে ২ থেকে ৩বার পর্যন্ত মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিবহন ভাড়া বেড়েছে। সবমিলে শ্রমিকদের জীবন নির্বাহের ব্যয় অসম্ভব রকমের বেড়েছে। সবকিছুর প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা যৌক্তিক হয়ে পড়েছে। এ কারণে শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুলেছে; আমরা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির তাবি তুলেছি।-------- আমরা এ সব হিসাবে করেই শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুলেছি। সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের যে বেতন ঘোষণা করেছে সেখানে ন্যুনতম বেতন ঘোষণা করা হয়েছে ৮২০০ টাকা বেসিক। সে জন্য আমরা শ্রমিকদের জন্য ন্যুনতম বেসিক দাবি করেছি ১০ হাজার টাকা। মোট মজুরি দাবি করেছি ১৬ হাজার টাকা। আজকে যখন শ্রমিকরা মজুরির বৃদ্ধির দাবি তুলেছে তখন চারদিকে কি অবস্থা করা হয়েছে। তাজরীন এবং রানা প্লাজার পর সারা দুনিয়োতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সম্পর্কে কি অবস্থা তৈরি হয়েছিল আপনারা জানেন। তাজরীন রানা প্লাজার পর বিদেশি সাংবাদিকরা বায়ার ও মালিককে প্রশ্ন করলে মালিকরা বলেছে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আছে। আমি পরিস্কার করে প্রশ্ন করতে চাই, শ্রমিকদের যদি ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকে তাহলে শ্রমিকরা যখন মজুরি বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করেছিল তখন তাদের কেন ছাটাই করা হয়েছে, কেন হামলা-মামলা দিয়ে শ্রমিকদের এলাকা ছাড়া করা হয়েছে? মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করার জন্য কেন তাদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে? মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের পর কেন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে? এই কি মালিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার নমুনা? এই আপনাদের ট্রেড ইউনিয়নের চেহারা---? আপনারা ট্রেড ইউনিয়নের কথা বলে আপনারা যা ইচ্ছা তাই করছেন? আজকে আপনাদের পকেটে অনেকগুলো শ্রমিক সংগঠন আছে। আপনারা তাদের বাইরে নিয়ে যান। তাদের ইউরোপে নিয়ে যান, আমেরিকায় নিয়ে যান। আপনারা বোঝাতে চান শ্রমিক সংগঠনগুলো আপনাদের পকেটের মধ্যে রয়েছে। ওই পকেটের সংগঠন পুরে আপনারা সারা দেশে শ্রমিক আন্দোলন দমন করতে চান। আমি পরিস্কার ভাষায় বলছি, সরকারের সাধ্য নেই, প্রধানমন্ত্রী আপনারও সাধ্য নেই এই ভাবে শ্রমিকদের আন্দোলন আপনি দমন করবেন। আমাদের যতক্ষন জীবন থাকবে ততক্ষন আমরা জান বাচি রেখে শ্রমিক মজুরিসহ সব ধরনের আন্দোলন আমরা করবো। শ্রমিকরা যখন মজুরিসহ অন্যান্য দাবির কথা বলে তখন সাথে সাথে শ্রমিকদের কারখানা থেকে বের করে দেয়া হয়। বলা হয়, তুমি নেতা হয়ে গেছো। নেতা হয়েছো বলতে কি বোঝাতে হয় তা জানেন আপনারা। তাহলে এই শ্রমজীবি মানুষের রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না? শ্রমজীবি মানুষ রাজনৈতিক নেতা হতে পারবে না? এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আজ সারা দেশে শ্রমজীবি মানুষ লান্ছিত, নিপীড়িত। ১৯৭২ সালে দেশে মাত্র পাঁচজন কোটিপতি ছিল। আজকে সারা দেশে ১৪ লক্ষ ২ হাজার ৪৬১ জন কোটিপতি হয়েছে। আর আমাদের শ্রমিকরা জীবন ধারনের মত মজুরি পাওয়ার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অমানবিক পরিশ্রম করছে। নারী শ্রমিক সম্পর্কে বলা হয়েছে রাত ৮ টার পর কারখানাতে কাজ করতে পারবে না। সারা বিশ্বেও এ আইন কার্যকর আছে। আমাদের কারখানা আইনে পরিস্কার করে বলা আছে। আর আমাদের নারী শ্রমিকরা সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত কাজ করে। তারপর এই মধ্য রাতে যখন নারী শ্রমিকরা রাস্তায় বের হয় তখন তারা নানাভাবে লান্ছিত হয়, নিপিড়ীতন্ন। আজকে প্রধানমন্ত্রী নারী , স্পীকার নারী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী বলে দাবি করা হয় কিন্তু নারীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতায় বসা এই নারীরা ক্ষমতায় বসলেও তারা পুরুষতান্ত্রিক। পোশাক কারখানার ৪৫ লাখ শ্রমিকদের মধ্যে ৮২ ভাগ নারী কর্মরত আছে। এটা কোনভাইে বরদাস্ত করা যায় না। আমরা বার বার বলেছি নারী শ্রমিকদের সাথে আপনারা যে ব্যবহার করছেন তা বন্ধ করুন। ¯^রাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় আমরা বার বার বলেছি, আপনি আশুলিয়ায় যেস শ্রমিককে গ্রেফতার করেছেন, মিথ্যা মামলা দিয়ে বাড়ী ছাড়া করেছেন। অবিলম্বে তা বন্ধ করুন, তাদের মুক্তি দিন। তাদের অপরাধ কি ছিলÑ তারা মজুরি বৃদ্ধির কথা বলেছে সেই জন্যই? আজকে তাদের ১৯৭৪ সালের বিশেষ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। শ্রমিকরা কি ক্রিমিনাল? তাদের ক্রিমিনাল এ্যাক্টে গ্রেফতার করা হয়েছে, শ্রমিকরা কি ক্রিমিনাল ? এ প্রশ্ন আইনজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবিরাও আজ এ দাবি তুলেছে। তাহলে কেন শ্রমিকদের উপর এত বরবরচিত হামলা করা হয়েছে? এই শ্রমিককের রক্ষঘামে অর্জিত বৈদেশিক মূদ্রার জন্য কৃতিত্ব নিতে চাইবেন। ৫০ বিলিয়ন ডলারের শিল্প দাঁড় করাতে চান। কিন্তু কার উপর এই ৫০ বিলিয়ন ডলারের শিল্প দাঁড় করাতে চান? আপনারা শ্রমিকদের উপর নিপীড়ন করে ৫০ বিলিয়ন ডলারে শিল্প দাঁড় করাতে চান। আমরা চাই বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানিতে দুই নম্বর নয়, এক নম্বরে আসুক। চীনকে টেক্কা দিয়ে বাংলাদেশ এক নম্বর হোক। কিন্তু শ্রমিকদের উপর দমন নিপীড়ন করলে, সব চেয়ে কম মজুরি দিলে চায়নার সাথে আপনার কিভাবে টেক্কা নিবেন আমরা তা বুঝি না। শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির যে আন্দোলন তুলেছে তা ভিক্ষা নয়। মালিকরা বলে তারা কারখানা করেছে বলে নারী শ্রমিকরা কাজ পেয়েছে। তার মানে কি পেটে খাওয়ার মত যে মজুরি লাগে সে মজুরি দিয়ে দেবেন না? চার/পাঁচ হাজার টাকা বেতন দিবে। এ টাকার তিন/চার হাজার টাকা বাড়িভাড়া দিতে চলে যায়। এ বেতন দিয়ে আমাদের বোনদের পেট চলে না রে ভাই। এই শ্রমিককে শহরে যেমন সংসার চালাতে হয়, গ্রামেও তাদের টাকা পাঠাতে হয়। একই সাথে তারা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখছে। শ্রমিকরা যদি প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয় শহরের পাশাপাশি গ্রামের অর্থনীতিও ধসে পড়বে। এই সমাবেশ থেকে পরিস্কার করে বলতে চাই গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের মুক্তি দিতে হব্। এ মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। শ্রমিকদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে যে হয়রানি করছেন তা বন্ধ করতে হবে। যদি তা বন্ধ না করেন তাহলে আশুলিয়াতে কি দেখেছেন, সারা দেশের তৈরি পোশাক শিল্প এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে। তখন আপরানার আন্দোলন ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। সুত্র: ১৩ জানুয়ারি জাতয়ি প্রেসক্লাবের সামনে শ্রমিক সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতা